স্বদেশ ডেস্ক:
মাসব্যাপী বন্যা উপদ্রুত এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই বন্যা আঘাত হানায় বিশেষ করে দিনমজুর এবং স্বল্প আয়ের মানুষ দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বানভাসি মানুষরা শিশু, বৃদ্ধ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন সড়ক, বাঁধ ও উঁচু জায়গায়। কেউ কেউ উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। বন্যার পানি না নামায় আসন্ন ঈদুল আজহার আগে বাড়ি ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন লাখো মানুষ। তাই এবারের কোরবানির ঈদের কোনো আনন্দ বা আমেজ নেই তাদের মনে। তাদের মনে কেবল অনিশ্চয়তা আর চিন্তা।
এ ছাড়া অনেকেই রয়ে গেছেন নিমজ্জিত বাড়িঘরে। তারা ঘরের চকির ওপর মাচা বানিয়ে কিংবা নৌকার ওপর নিদারুণ কষ্টে দিন-রাত পার করছেন। দিনের বেলায় কেউ কেউ ঘরের চালার ওপর বসে থাকেন। পানিবন্দি ও বাঁধে আশ্রয় নেওয়া নি¤œআয়ের মানুষ খাবারের সংকটে পড়েছেন। তাদের অভিযোগÑ কর্মহীন অবস্থায় এক মাস অতিবাহিত করলেও মাত্র ৮-১০ কেজি চাল ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন তারা। আবার অনেক পরিবারের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। এসব পরিবারকে একবেলা খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবাহিত রোগÑ ডায়রিয়া, আমাশয়, সর্দি-কাশি, জ্বর, হাপানির প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
এদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আশপাশের নদ-নদীতে ফের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ধরলা ও তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ ছাড়া ঢাকা জেলার আশপাশের নদীগুলোর পানি বৃদ্ধিও আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি কমছে। এ ছাড়া গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
এর ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর এবং নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পাবে। অপরদিকে নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।
জামালপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, যমুনার পানি কিছুটা কমলেও বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রের। এতে বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে দুর্ভোগ বেড়েই চলছে বানভাসি মানুষের। আর আসন্ন কোরবানির ঈদের আগে তাদের এই কষ্ট যাবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ জানান, কয়েক দিন পানি কমলেও আবার যমুনা নদীর পানি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে।
নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, যমুনার পানি গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ১৭ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাঙ্গালি নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনা নদীতে পানি কমলেও সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলের চালুয়াবাড়ী, কর্নিবাড়ী, কুতুবপুর, চন্দনবাইশা, কাজলা, কামালপুর, রহদহ ও সারিয়াকান্দি সদরসহ সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল এবং পাট, ধানসহ ফসলি জমি এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ।
নিজস্ব প্রতিবেদক, কুড়িগ্রাম জানান, এবারের বর্ষা মৌসুমে পর পর ৩য় বারের মতো বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে জেলার দুটি পৌরসভা ও ৫৬টি ইউনিয়ন। দীর্ঘ এক মাস ধরে খাদ্য, বাসস্থান, গোখাদ্য, পয়নিষ্কাশনের স্থান, বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকটে ভুগছেন বানভাসিরা। চলাচলের রাস্তা ডুবে থাকায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন আড়াই লাখ মানুষ।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নদ-নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে প্লাবিত অনেক এলাকার বন্যার পানিও নেমে গেছে।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, জেলার সব নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি এখনো বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রায় এক মাস ধরে বন্যার পানি আটকে থাকায় উপদ্রুত এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দিনমজুর এবং স্বল্পআয়ের লোকজন দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। যেসব পরিবার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বিভিন্ন উঁচু স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তারা বাড়ি ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। জেলার চারটি উপজেলার ৬৫টি চরাঞ্চলের বসতবাড়িগুলো দীর্ঘদিন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ঘরের বেড়া, খুঁটি। অনেক ঘরের টিনের চাল খুলে পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এতে বসতবাড়ি হারিয়ে বিপাকে পড়েছে বন্যাকবলিত কর্মহীন পরিবারগুলো। বেসরকারি সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেনি। সরকারি ত্রাণও নিতান্তই অপ্রতুল।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, যমুনার পানি কিছুটা কমে এখনো প্রবলবেগে বইছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১০ সেন্টিমিটার কমলেও বিপদসীমার ৭১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে সিরাজগঞ্জ পাউবো সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে ঈদের আনন্দ নেই সিরাজগঞ্জের বন্যাকবলিত ছয়টি উপজেলার বানভাসি দুই লক্ষাধিক অসহায় মানুষের। এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে জেলার ছয় উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নে নিম্নাঞ্চলের প্রায় আড়াইশ গ্রামের ঘরবাড়ি, বসতভিটা, জমিজমা। বানভাসি মানুষরা শিশু, বৃদ্ধ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাঁধ ও উঁচু জায়গায়। অনেকেই রয়ে গেছেন নিমজ্জিত বাড়িঘরে। জেলার কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী ৩৩টি ইউনিয়নের ২১৬টি গ্রামের এক লাখ ৫৯ হাজার ১৫৩ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় পদ্মা নদীর পানি আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী সদর, কালুখালী ও পাংশা উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে পদ্মা নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। জেলায় ৩৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। সামনে ঈদ, তাদের আনন্দ পানিতে ভেসে গেছে। দৌলতদিয়ায় ৪টি ফেরিঘাটের মধ্যে দুটি ফেরিঘাট পানিতে আংশিক ডুবে গেছে। গোয়ালন্দ বাজার থেকে দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত রেলপথ পানিতে ডুবে যাওয়ায় ১০ দিন ধরে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ।
সদরপুর (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি সদরপুরে। দীর্ঘ দিনের দাবির প্ররিপ্রেক্ষিতে উপজেলা সদরে নবনির্মিত অটোবাইক স্ট্যান্ডটি ¯্রােতের তোড়ে ভেঙে গেছে।
তৃতীয় দফায় পানি বৃদ্ধির ফলে চরাঞ্চলের বানভাসি পরিবারগুলোয় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়াও অনেক পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় মানুষগুলো পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকে ঈদের আগে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন না বলে আশঙ্কা করছেন। তাদের মনে ঈদের কোনো আনন্দ নেই, তাদের আছে কেবল দুশ্চিন্তা।